Tuesday, February 22, 2011

পানকৌড়ির গল্প: ০০১

Meddah (The Story Teller)
পানকৌড়ির গল্প কিছু কাল্পনিক চরিত্র ও ঘটনার সন্নিবেশ। অবসরে কী বোর্ডের উপর আলতো হাতে ফুটিয়ে তোলার চেস্টা কিছু শব্দচিত্রের নির্মাণ যা খুব অজান্তে হৃদয়কে স্পর্শ করে। জীবন নদীর মতো প্রবাহমান। সময়ের সকল ব্যবধানকে অতিক্রম করে তার মাঝে বেঁচে থাকে খন্ড খন্ড গল্পগুচ্ছ। কিছু গল্প চলে আমাদের আলাপনে। কিছু গল্প আমরা বয়ে বেড়াই অদ্ভুত এক বোঝার মতো। আমাদের গল্পগুলো তার চরিত্রে আর প্রকাশে এক অনন্য আনন্দ বেদনার কাব্য। পানকৌড়ির গল্প শুরু হলো তুরস্কের মেদ্দার (গল্প বলিয়ে'র) অবলম্বনে। মেদ্দারা ভ্রাম্যমান গল্পকার যারা কফি হাউজের সামনে লোকজন জড়ো করে গল্প শুনাতেন যার মধ্যে থাকত অনেক নীতিকথা। তাহলে শুরু হোক পানকৌড়ির গল্প। এতে নীতিকথা তেমন না থাকলেও জীবনের বিচিত্র কথামালা নীরবে ঠাঁই নেবে।

এই তো আজকাল সবার সাথে যোগাযোগ হয় ফেইসবুকের মাধ্যমে। ই-মেইল চালাচালিও হয় ফেইসবুকের মাধ্যমে। এমনিভাবে যোগাযোগ শুরু হয় আমার স্কুলের এক সিনিয়র ভাই মাহমুদ ভাইয়ের সাথে। কলেজ রিইউনিয়নে তাঁর উষ্ণ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়। গত বছরে এখানে অনুষ্ঠিত আমাদের কলেজ রিইউনিয়নে উপস্থাপনার গুরুদায়িত্বটি তিঁনি সুচারুভাবে পরিচালনা করেছিলেন। বেশ মজার মানুষ। আড্ডা জমিয়ে রাখতে তিঁনি ওস্তাদ। সম্প্রতি দ্য নাইনথ ডিমেনশন শিরোনামে একটা ব্লগও শুরু করেছেন। থাকেন আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য টেক্সাসে। ওয়াশিংটন ডিসি'র জুলাই মাসের অসহ্য গরমকে তিঁনি বেশ তাচ্ছিল্য করে বললেন, "এটা কোন গরম না কি"? ডিসি'তে তাপমাত্রা নব্বই ছুঁলে আমরা জিহবা বের করে শ্বাস নেই। দু'মিনিট বাইরে থাকলে পাঁচ মিনিট গাড়ীতে বা ঘরের ভেতরে গিয়ে শীতল হবার চেস্টা করি।

কিন্তু এবার বিধি বাম! এবারের শীতে গরমের দেশ টেক্সাসে হলো তুমুল তুষারপাত। গ্রীষ্মের রাজ্য টেক্সাস আর যাই হোক না কেন তুষারপাতের জন্য প্রস্তুত ছিল না। মাহমুদ ভাই টেক্সাসের তুষারপাতের ছবি পোস্ট করেন ফেইসবুকে। এমন উত্তম সুযোগ খুব কম পাওয়া যায়। তাই, মাহমুদ ভাইকে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করলাম, আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ভার্জিনিয়ায় চলে আসার জন্য। ভার্জিনিয়ার শ্লোগান হচ্ছে: ভার্জিনিয়া ইজ ফর লাভার্স। শ্লোগানটা বেশ উপাদেয়। লোকজন জড়ো করার জন্য বড্ডো আকর্ষণীয় ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপন। কিন্তু মাহমুদ ভাই বড্ডো আত্মাভিমানী ও গর্বিত টেক্সান। তিঁনি অনড়। এই সাময়িক দুর্যোগ তাঁকে বিচলিত করে না। যেখানেই আমাদের বাস, সেখানেই আঁশ। জীবনের শেকড় গেড়ে যেখানে আমরা বেড়ে উঠি তা থেকে দূরে সরে আসা সম্ভব নয়। তারপরও চেস্টা করতে অসুবিধে কি? টেক্সাস নিয়ে কথা হতেই একদিন মাহমুদ ভাইকে বললাম আমার এককালের রুমমেইট ও বন্ধু রুপকের কথা। তাই, রুপকের কথা হলো আজকের গল্পের মূল নকশা।

ঘটনাটা বহু বছর আগের ঘটনা। আমরা যে ক'জন বেশ ক'বছর ধরে একটা বাড়ী ভাড়া নিয়ে থাকতাম সেখানে রুপক ছিল আমাদের মধ্যমণি। চুটিয়ে আড্ডা জমিয়ে আমাদের মজিয়ে রাখতে সে জানত। রাত ভরে আড্ডা দিতে জানে। উইকএন্ডে রাত ৩টায় সবাইকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যেত ফাস্ট ফুড স্টোরে। খাওয়ার ব্যাপারে তার অরুচি দেখিনি কোনদিন। দেশীয় খাবার পেলে বড্ডো আহলাদ নিয়ে খেত। এমন ভোজনবিলাসী রুপকের কদর অন্দরমহলে একটু বেশী ছিল। কারণ, রান্নার প্রতিটি আইটেম আকন্ঠ খেয়ে তার দীর্ঘ প্রশস্তি করতে রুপকের ছিল অদ্ভুত মুন্সীয়ানা। আর দরাজ প্রশস্তির কারণে ভাবীরাও ওর বেশ অনুরক্ত ছিল। ঘন ঘন ডাক পড়তো। কিন্তু রুপক বড্ডো সেয়ানা। খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত। এর বেশী কিছু না।

ভাবীরা ইনিয়ে বিনিয়ে তাদের সুদর্শনা সুযোগ্যা স্বজনদের কথা পাড়লেও সেটা সে হেসে উড়িয়ে দিত। আমরা জানতাম, রুপকের বিয়ে মোটামুটি স্থির। তার বাবা এক সুশ্রী পাত্রী স্থির করে রেখেছেন। সেবছর ছুটি নিয়ে রুপক বাংলাদেশে গেছে। বিয়ে করে সস্ত্রীক ফিরবে। তারপর লেজকাটা রুপক চলে যাবে অন্য জগতে। আমরা ব্যাচেলররা হারাব একজন সুযোগ্য কুমার বন্ধু। তাতে ক্ষোভ নেই। কারণ, সেই পায়তারা আমাদের সকলের অন্তরে বিরাজ করছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি রুপকের সস্ত্রীক ফেরতের। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় রুপকের বিয়ে না করে আমেরিকায় ফিরে আসার খবর পেয়ে আমরা বজ্রাহত। ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করেছে। আমরা চার বন্ধু ওয়াশিংটনের ডালেস এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছি। একসময় একটা স্যুটকেস নিয়ে ত্রস্তভাবে রুপক বেরিয়ে আসে। সদা হাস্যময় রুপক মুখে যেন কুলুপ পড়েছে। শুধু বলল, "আগে বাড়ী চল"। আমরা জোর গতিতে গাড়ী হাঁকিয়ে বাড়ী ফিরলাম। সবাই জড়ো হয়ে বললাম, "ঘটনা কি"?

রুপক নিরুত্তর। বলে, "আগে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নিই"। স্নান করে ফ্রেশ হয়ে ফেরে। আমরা ড্রইং রুমে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। ভোজনবিলাসী রুপক অনড়। মুখ বন্ধ। কিছু বলে না। বলে, "আগে ভাত খাব"। খেতে খেতে আমরা প্রশ্ন ছুঁড়তে থাকি: পাত্রী কি খাটো? শ্যামলা? অন্য কোথাও বাগদত্তা? খুঁড়িয়ে হাঁটে? বলতে বলতে প্রশ্ন তীব্রতর হতে থাকে। আগে কি একবার বিয়ে হয়েছিল? রুপক ভাত খায়। শুধু মাথা নাড়ে। কোন উত্তর দেয় না। আমরা চারজন মাংস তুলে দিচ্ছি। মরিচ এগিয়ে দিচ্ছি। লেবু এগিয়ে দিচ্ছি। না, কোন রা নেই। ভাত খাওয়া শেষ। বন্ধুবর জামান ফ্রিজ থেকে মিস্টি দিল। চামচ দিয়ে রসিয়ে মিষ্টি খাচ্ছে।

এবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গল। আমরা চীৎকার শুরু করলাম। গালাগালি দিচ্ছি, "রুপক, কি কারণে তুই বিয়ে করলি না তোর বাবার পছন্দের পাত্রীকে"। উত্তর যখন এলো আমরা সবাই বাক্যহারা। হুম, রুপকের মেয়ে পছন্দ হয়েছিল। হবু শ্বশুরকেও পছন্দ হয়েছিল। শ্বাশুড়ীকেও। তাহলে সমস্যা কোথায়? পাত্রী সব ভাইবোনদের ছোট। "তা তো বেশ ভাল" তুই সবার আদরের ছোট জামাই হবি। পাত্রীর বড়ো তিন ভাই টেক্সাস থাকেন। তেলের (গ্যাস স্টেশন) ব্যবসা করেন। "এতে সমস্যা কি"? সমস্বরে আমাদের প্রশ্ন। আমাদের সবাইকে অবাক করে কান্না কান্না সুরে রুপক উত্তর দেয়: "এই পাত্রীকে বিয়ে করলে আমাকে যদি টেক্সাসে মুভ করতে হয়? আমি তো গরমের রাজ্য টেক্সাসে মুভ করতে পারব না"। উত্তর শুনে আমাদের আক্কেল গুড়ুম। বিয়ে না করার বা না হওয়ার অনেক অজুহাত থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে: "টেক্সাস! হায় রে, টেক্সাস"!